হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, পবিত্র কাবার ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে কেবল একজনই ব্যক্তি আছেন, যাঁর সম্মানে কাবার প্রাচীর বিদীর্ণ হয়েছিল এবং যাঁর জন্ম আল্লাহর ঘরে হয়েছিল। তিনি আলী ইবনে আবু তালিব (আ.)।
শিয়া ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী, এই জন্ম কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিল না, বরং এটি ছিল বিশ্ববাসীর কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা যে, যিনি কাবার ভেতরে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন, তিনিই কাবার প্রকৃত আমানতদার এবং রাসূলের (সা.) যোগ্য উত্তরসূরি।
ফাতিমা বিনতে আসাদ (আ.) যখন প্রসব বেদনা নিয়ে কাবার নিকট আসেন, তখন তিনি প্রার্থনা করেছিলেন— "হে আল্লাহ! আমি তোমার ওপর এবং তোমার ঘর পুনর্নির্মাণকারী ইব্রাহিমের ওপর বিশ্বাস রাখি। এই নবজাতকের উসিলায় আমার প্রসব বেদনা সহজ করে দাও।" তৎক্ষণাৎ কাবার 'রুকন-এ-ইয়ামানি' নামক কোণটি ফেটে যায় এবং তিনি ভেতরে প্রবেশ করেন। তিন দিন তিনি সেখানে আল্লাহর মেহমান হিসেবে ছিলেন। এই অলৌকিকতা আলীর (আ.) পবিত্রতার প্রথম সাক্ষ্য।
রাসূলের (সা.) ছায়াতলে লালন-পালন ও প্রথম ঈমান
হযরত আলীর (আ.) জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর শৈশব। তিনি কোনো মূর্তিপূজার সংস্পর্শে আসেননি। জন্মের পর থেকেই তিনি রাসূলে খোদার (সা.) কোলে বড় হয়েছেন। আমিরুল মুমিনীন নিজেই বলেছেন, "রাসূল (সা.) আমাকে নিজের সাথে রাখতেন, আমাকে খাবার খাইয়ে দিতেন এবং আমি তাঁর ঘ্রাণ নিতাম যেমন একটি উটের বাচ্চা তার মায়ের পিছু নেয়।"
ইসলাম যখন প্রকাশ্যে আসে, তখন পুরুষদের মধ্যে তিনিই প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। শিয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে, আলী (আ.) 'ইসলাম গ্রহণ' করেননি বরং তিনি 'জন্মগতভাবে মুসলিম' ছিলেন এবং প্রথম থেকেই ইসলামের পতাকাবাহী ছিলেন। 'দাওয়াতে জুল-আশিরা' বা নিকটাত্মীয়দের দাওয়াতের দিন মহানবী (সা.) আলীকে তাঁর ভাই, প্রতিনিধি এবং উত্তরসূরি (খলিফা) হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
মহাবীর আসাদুল্লাহ—যিনি খায়বার ও খন্দকের ত্রাস
ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষার প্রতিটি যুদ্ধে আলীর (আ.) তলোয়ার 'জুলফিকার' ছিল প্রধান ভরসা।
বদর ও ওহুদ: যেখানে বড় বড় বীরেরা পিছু হটেছিলেন, সেখানে আলী (আ.) রাসূলের (সা.) ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ওহুদের যুদ্ধে আকাশ থেকে আওয়াজ এসেছিল— "লা ফাতা ইল্লা আলী, লা সাইফা ইল্লা জুলফিকার" (আলী ছাড়া কোনো বীর নেই, জুলফিকার ছাড়া কোনো তলোয়ার নেই)।
খন্দকের যুদ্ধ: আমর ইবনে আবদু উদকে পরাজিত করার পর রাসূল (সা.) বলেছিলেন, "আজকের দিনে আলীর একটি আঘাত কেয়ামত পর্যন্ত জিন ও ইনসানের ইবাদতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।"
খায়বার জয়: কামুস দুর্গ যখন কেউ জয় করতে পারছিল না, তখন রাসূল (সা.) ঘোষণা দেন— "কাল আমি এমন এক ব্যক্তির হাতে পতাকা দেব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালোবাসেন।" সেই ব্যক্তি ছিলেন আলী (আ.)।
ইলম ও হিকমতের মূর্ত প্রতীক: ‘জ্ঞানের নগরীর দ্বার’
হযরত আলী (আ.) ছিলেন ঐশী জ্ঞানের ভাণ্ডার। পবিত্র কোরআনের প্রতিটি আয়াতের শানে নুযুল এবং গূঢ় অর্থ তাঁর নখদর্পণে ছিল।
নাহজুল বালাগা: এটি আলীর (আ.) খুতবা, চিঠি ও বাণীর সংকলন। এর প্রতিটি শব্দ মানবজাতির জন্য একেকটি দর্শনের বই।
বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যা: তিনি সেই যুগে ভ্রূণতত্ত্ব, মহাকাশ বিজ্ঞান এবং গণিত নিয়ে এমন সব তথ্য দিয়েছেন যা আধুনিক বিজ্ঞান আজ প্রমাণ করছে।
বিচারব্যবস্থা: আলীর (আ.) বিচারকার্য আজও বিশ্বের আইনবিদদের জন্য পাঠ্য। তাঁর সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধি দেখে সমসাময়িকরা বলতে বাধ্য হতেন— "আলী না থাকলে আমরা ধ্বংস হয়ে যেতাম।"
সামাজিক ন্যায়বিচার ও শাসনামল
যখন তিনি খিলাফতের দায়িত্ব নিলেন, তিনি এক নজিরবিহীন শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন।
সাম্য: তিনি নিজের ভাই আকিল ইবনে আবু তালিবকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অতিরিক্ত অর্থ দিতে অস্বীকার করেন, কারণ তা ছিল জনগণের সম্পদ।
দরিদ্রবান্ধব: তিনি রাতের অন্ধকারে নিজের কাঁধে আটার বস্তা নিয়ে বিধবা ও এতিমদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতেন, অথচ কেউ জানত না তিনি আমিরুল মুমিনীন।
মালিক ইবনে আশতারকে লেখা চিঠি: মিশরের গভর্নর হিসেবে মালিক আশতারকে তিনি যে দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন, সেটি আজও জাতিসংঘের দৃষ্টিতে সুশাসনের শ্রেষ্ঠ দলিল হিসেবে স্বীকৃত। সেখানে তিনি লিখেছিলেন— "মানুষ দুই প্রকার: হয় তোমার দ্বীনি ভাই, না হয় তোমার সৃষ্টিগত সমান।"
আধ্যাত্মিকতা
হযরত আলী (আ.)-এর আধ্যাত্মিক জীবনের মূল ভিত্তি ছিল আল্লাহর পরিচয় বা 'মা’রেফাত'। তিনি আল্লাহকে ভয় পেয়ে ইবাদত করতেন না, বরং তিনি আল্লাহকে ইবাদতের যোগ্য মনে করতেন বলেই তাঁর সেজদায় লুটিয়ে পড়তেন।
মাওলা আলী (আ.) ইবাদতকারীদের তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। তিনি বলতেন:
"একদল লোক জান্নাতের আশায় আল্লাহর ইবাদত করে, এটা হলো ব্যবসায়ীদের ইবাদত। একদল লোক জাহান্নামের ভয়ে ইবাদত করে, এটা হলো গোলামদের ইবাদত। আর একদল লোক আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য এবং তাঁকে ইবাদতের যোগ্য মনে করে তাঁর বন্দেগি করে—এটাই হলো স্বাধীন ও প্রকৃত মুক্ত মানুষের ইবাদত।"
আধ্যাত্মিক সাধনায় আলীর (আ.) নিমগ্নতা ছিল কিংবদন্তীতুল্য। এক যুদ্ধে তাঁর পায়ে একটি তীর বিঁধেছিল, যা সাধারণ অবস্থায় বের করা অসম্ভব ছিল প্রচণ্ড ব্যথার কারণে। মহানবী (সা.)-এর পরামর্শে তিনি যখন নামাজে দাঁড়ালেন, তখন সাহাবীরা সেই তীর টেনে বের করে আনলেন। নামাজ শেষ হওয়ার পর আলী (আ.) জিজ্ঞেস করলেন, "তীরটি কি বের করা হয়েছে?" অর্থাৎ, আল্লাহর সাথে কথোপকথনের সময় তিনি নিজের দেহ ও পার্থিব জগতের অস্তিত্ব ভুলে যেতেন।
একবার এক ব্যক্তি আলীকে (আ.) প্রশ্ন করেছিলেন, "আপনি কি আপনার রবকে দেখেছেন?" তিনি উত্তরে বলেছিলেন: "আমি এমন রবের ইবাদত করি না যাঁকে আমি দেখি না। তবে চোখ তাঁকে স্থলভাবে দেখে না, বরং হৃদয়ের নূর ও ঈমানের হাকিকত দিয়ে তাঁকে অনুভব করা যায়।" এটি শিয়া আধ্যাত্মিক দর্শনের একটি প্রধান স্তম্ভ—যেখানে আল্লাহকে দেখার অর্থ হলো অন্তরের চোখে তাঁর গুণাবলি প্রত্যক্ষ করা।
সংকলন: সৈয়দ ইয়াসিন মেহদী ইফাজ
আপনার কমেন্ট